ভারত যে ফাঁ সির খেলাটা খেলছে হাসিনাকে দিয়ে
পুরান ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য, সাতবারের সংসদ সদস্য ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সংসদবিষয়ক উপদেষ্টা সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে ২০১৫ সালের ২২ নভেম্বর মধ্যরাতে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ফাঁসিতে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছিল। এর আগে তিনি কলেমা পড়তে পড়তে ওই ফাঁসির মঞ্চের দিকে এগিয় গিয়েছিলেন। পরে কারা কর্তৃপক্ষ তার লাশ চট্টগ্রামে পাঠানোর ব্যবস্থা করেছিল।
ওই রাতে জল্লাদ তাকে ফাঁসিতে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের আগে কারা কর্তৃপক্ষ বিধি অনুযায়ী তাকে তার পরিবারের সদস্যদের সাথে একান্তে কথা বলার সুযোগ দেয়। এর আগে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চাওয়ার আবেদন করতে বলা হয়েছিল। কিন্তু তিনি কারা কর্তৃপক্ষের সেই আবেদনে সাড়া না দিয়ে বলেছিলেন, ‘আমি তো কোনো অপরাধ করিনি। আমি কার কাছে মাফ চাইব? ওই দাদাদের কাছে মাফ চাইব? তাদের কাছে চাওয়ার তো প্রশ্নই আসে না’।
যদিও কারা কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে একজন কর্মকর্তা দাবি করছেন, সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী ফাঁসির মঞ্চে যাওয়ার আগে নিজ হাতে লেখা রাষ্ট্রপতির কাছে প্রানভিক্ষার জন্য আবেদন করেছিলেন। এমন নথি কর্তৃপক্ষের কাছে রয়েছে বলে দাবি করা হচ্ছে।
তবে এমন কথার বিপরীতে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ভাই গিয়াস কাদের চৌধুরী বলছেন, যদি এমন প্রাণভিক্ষার কোনো ধরনের আবেদনের নথি কারা কর্তৃপক্ষের কাছে থাকে তাহলে সেটা তারা দেখাক?
যেভাবে ফাঁসি কার্যকর : ২০১৫ সালের ২২ নভেম্বর। সন্ধ্যার পরপরই ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের প্রধান গেট দিয়ে ঢাকার সিভিল সার্জনসহ প্রশাসনের যেসব কর্মকর্তার উপস্থিতিতে ফাঁসি কার্যকর হওয়ার কথা তাদের সবাই এক এক করে কারাগারের ভেতরে প্রবেশ করতে থাকেন। ভেতরে যাওয়ার পর তাদের সবার মোবাইল বন্ধ হয়ে যায়। রাত যত বাড়তে থাকে কারাগারের ভেতরে সুনশান নীরবতাও বাড়তে থাকে। বন্দীদের সবাইকে লকাবে আটকে ফেলা হয়। এরপরই কারা কর্তৃপক্ষের ডাকে সাড়া দিয়ে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর সাথে তার স্ত্রী, সন্তান ও পরিবারের অন্য সদস্যরা কারাগারে প্রবেশ করে সোজা কনডেম সেলের ৮ নম্বর কক্ষে চলে যান। যেটির দৈর্ঘ্য এবং প্রস্থ তিন-ছয় হাত।
নেই জানাল। সেখানে তাদের মধ্যে একান্তে শেষ বিদায়ী সাক্ষাৎ অনুষ্ঠিত হয়। অশ্রুসিক্ত স্বজনরা বের হওয়ার পর শুরু হয় তাকে তওবা পড়নোসহ ফাঁসির প্রস্তুতি। ৮ নম্বর সেল থেকে ফাঁসির মঞ্চের দূরত্ব মাত্র কয়েক হাত। জল্লাদ যখন তাকে ফাঁসির মঞ্চের দিকে নিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন তার মুখে শেষ কথাগুলো ছিল শুধুই কলেমা। মৃদু স্বরে কলেমা পড়তে পড়তে ফাঁসির মঞ্চের দিকে এগিয়ে যান তিনি। এরপর রাত ১২টা ৪৫ মিনিটে জল্লাদ লিভার টান দিয়ে তার ফাঁসি কার্যকর করেন। এ দিন তার সাথে একই সময়ে ফাঁসি কার্যকর করা হয় বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল ও সাবেক সমাজকল্যাণ মন্ত্রী আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ।
এসব তথ্য জানিয়ে একজন সরকারি কর্মকর্তা নাম না প্রকাশের শর্তে গতকাল নয়া দিগন্তকে বলেন, ফাঁসি কার্যকর হওয়ার আগে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী এবং আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ দু’জনই নফল নামাজ পড়েছিলেন। দোয়া পড়তে পড়তে তারা দু’জনে পাশাপাশি থাকা ফাঁসির মঞ্চে গেছেন। তিনি বলেন, ফাঁসি কার্যকর হওয়ার পর গোসল করানো হয়। এরপর লাশ কফিনে ভরা হয়। মসজিদের ইমাম সাহেব নামাজে জানাজা পড়ানোর পর সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীসহ দু’জনের লাশ পুলিশের কাছে লাশ হস্তান্তর করা হয়। পরে পুলিশ উনাদের দেয়া ঠিকানায় লাশ পৌঁছে দেয়।
ওই কর্মকর্তা দাবি করেন, ফাঁসি কার্যকর হওয়ার আগে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী নিজ হাতে প্রাণভিক্ষার জন্য রাষ্ট্রপতির কাছে আবেদন করেছিলেন। যদিও তিনি এ ব্যাপারে বিস্তৃত কথা বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন। তার বক্তব্য হচ্ছে এই বিষয়টি খুবই সেনসিটিভ। তার পরিবারের পক্ষ থেকে কী বলা হচ্ছেÑ সেটাই আগে শোনা দরকার বলে জানান তিনি। তবে তার প্রাণভিক্ষা চাওয়ার আবেদন কারা কর্তৃপক্ষের কাছে এবং মন্ত্রণালয়ে সরকারের নথিতে আছে বলে দাবি করেন তিনি।
কারা অধিদফতরের দায়িত্বশীল একাধিক কর্মকর্তা গতকাল নয়া দিগন্তকে বলেন, সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ফাঁসি হওয়ার আগে সাবেক প্রধানমন্ত্রীসহ অনেকের বিরুদ্ধেই তিনি বেশ জোরেশোরে কথা বলতেন। এর মধ্যে ফাঁসি দেয়া প্রসঙ্গে একদিন শেখ হাসিনাকে উদ্দেশ করে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে এই টুকুই বলতে শুনেছিলাম, ‘এখানে আমার বইনের কিছু করার নাই, এটা তো অন্য জায়গার খেলা’। কাশিমপুর কারাগারে থাকা অবস্থায় সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী প্রায় কাছের লোকজনের কাছে বলতেন, তিনি কোনো অপরাধ করেননি, তাহলে তিনি কী কারণে প্রাণভিক্ষা চাইবেন? বরং তিনি তার পরিবারের মাধ্যমে দেশবাসীর উদ্দেশ মেসেজ দিয়ে বলেছিলেন, ‘যুদ্ধপরাধ ট্রাইব্যুনালে মামলার বিচার কার্যক্রম থেকে শুরু করে ফাঁসির রায় হওয়া পর্যন্ত পুরোটাই ছিল শেখ হাসিনা এবং তার সরকারের বিচারালয়ের একটা সাজানো নাটক।
তিনি এ-ও বলতেন, ফাঁসি হলে হবে, তবুও তিনি শেখ হাসিনা বা তার ‘প্রভু’ ভারতের দাদাদের কাছে নতি স্বীকার করবেন না। আর রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা কেন চাইবেন? যদি প্রাণভিক্ষা চাইতেই হয়, তাহলে তিনি মহান রাব্বুল আলামিনের কাছেই চাইবেন, অন্য কারো নয়’।
উল্লেখ্য, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় অপরাধ সংগঠনের দায়ে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল যে ছয়জন বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ ও সামাজিক ব্যক্তিত্বকে শেখ হাসিনার সরকারের বিচার বিভাগ মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করে তাদেরই একজন হচ্ছেন চট্টগ্রামের জনপ্রিয় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ফাঁসির মঞ্চে যাওয়ার আগ পর্যন্ত শেষ তিন দিন অথবা চার দিন সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ফাঁসির মঞ্চের কয়েক হাত দূরের ৮ সেলের একটি (কনডেম সেল) কক্ষে রাখা হয়েছিল। এর আগে অবশ্য বেশির ভাগ সময়ই তাকে কাটাতে হয়েছিল কাশিমপুর কারাগার পার্ট-১ এর ১/৩ নম্বর (হাসপাতালের পাশে) একটি কক্ষে। সেখানে পাশাপাশি তিনটি রুম রয়েছে। তার একটিতে তিনি থাকতেন। অবশ্য ধানমন্ডির সেইফ হাউজ থেকে গ্রেফতার হওয়ার পর তাকে কয়েক মাস
পুরান ঢাকার নাজিমউদ্দিন রোডের (বর্তমানে পরিত্যক্ত) ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে রাখা হয়েছিল। সেখানে যাওয়ার পর তাকে দফায় দফায় তখনকার গঠিত টাস্কফোর্সের সদস্যরা কারাগারের গেটের সামনে জিজ্ঞাসাবাদ করেছিলেন। ওই সময় সাক্ষাৎ কক্ষে কারা গেটের সামনে তার মেয়েকে বুকে জড়িয়ে অনেকের সামনেই তিনি চিৎকার করে বলেছিলেন, এই সব যুদ্ধাপরাধ মামলা টামলার নাটক শেখ হাসিনার গল্প ছাড়া আর কিছুই নয়। এসব মিথ্যা মামলায় তার কিচ্ছুই হবে না বলেও তিনি তার মেয়েকে সান্ত্বনা দিয়েছিলেন। কাশিমপুর কারাগারে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ওই কারাগারের হাসপাতালের ১/৩ নম্বর একটি সেলে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীসহ তিনজনকে রাখার ব্যবস্থা করেন কারা কর্তৃপক্ষ। তিন রুমের একটিতে ছিলেন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির এবং যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল মামলায় আমৃত্যু কারাদণ্ড পাওয়া আসামি মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী। অপরটিতে ছিলেন ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলার অন্যতম আসামি উইং কমান্ডার (অব:) সাহাবুদ্দিন আহমেদ। ওই কারাগারে বন্দী থাকার সময় সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর খেদমতে নিয়োজিত ছিলেন এমন একাধিক কারারক্ষীর সাথে সালাহউদ্দিন কাদের মন খুলে কথা বলতেন। বলতেন তার জীবনে ঘটে যাওয়া অনেক আলোচিত কথা ও গল্প। প্রায় সময়ই তিনি শেখ হাসিনা (সাবেক প্রধানমন্ত্রী) এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রীর নাম ধরেই নানা কথা বলতেন। তবে যুদ্ধাপরাধ মামলায় তার ফাঁসি হচ্ছেÑ এটা তিনি কখনো বিশ্বাসই করতেন না। উল্টো সেলে থাকা অন্যদের কাছে শতভাগ কনফিডেন্স নিয়ে বলতেন, ‘শেখ হাসিনা তাকে জেল খাটালেও শেষ পর্যন্ত তাকে ফাঁসি দেয়ার সাহস দেখাবে না। দিতে পারবেও না। কারণ হাসিনার সাথে তার পরিবারের যেমন সম্পর্ক তেমনি রয়েছে ব্যক্তিগত সম্পর্কও।’
কারাগারের একজন দায়িত্বশীল সদস্য নয়া দিগন্তকে বলেন, কাশিমপুর কারাগারে থাকার সময় সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী প্রতিদিন নামাজ পড়তেন। রোজা রাখতেন এবং নিয়মিত কুরআন তেলাওয়াত করতেন। বাকি সময় দেশের রাজনীতি, পারিবারিক ইতিহাস, সামাজিক কাজ নিয়ে আলোচনাসহ বিভিন্ন বিষয়ে খোশ গল্প করতেন। এর মধ্যে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং ইন্ডিয়া সরকারের বেশি বেশি সমালোচনা করতেন তিনি।
0 Comments